১৪. সলিল সমাধি
নীহাররঞ্জন গুপ্ত দ্বারাসলিল সমাধি
গভীর
রাত্রি।
সুব্রত আর রাজু
অঘোরে ঘুমিয়ে।
অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ঘুম এল না বলে কিরীটী শয্যা হতে উঠে
বসল। স্লিপিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে কেবিনের দরজাটা খুলে সে বেরিয়ে এল এবং আস্তে
আস্তে সেলুন
ডেকের দিকে চলল।
ডেকের কাছাকাছি আসতেই হাওয়াইন গিটারের একটা মধুর বাজনার শব্দ কানে
এল।
কিরীটী ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়াল।
ডেকের ওপর যে আলোটা রয়েছে সেটা খুব শক্তিশালী নয়। সেই ম্রিয়মাণ আলোয়
ডেকের ওপর এক অপূর্ব
আলো-ছায়ার সময় হয়েছে।
সেই আলো-ছায়া-ঘেরা
ডেকের ওধার থেকেই বাজনার অপূর্ব
আওয়াজটা ভেসে আসে।
কিরীটী পায়ে পায়ে ডেকের ওপর এসে দাঁড়াল।
নিশীথের নিঝুম
আঁধারে সাগরবক্ষ থেকে অপূর্ব
এক গুমগুম শব্দ ভেসে আসে।
মাথার ওপর তারায় ভরা আকাশের ছায়া সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের মাথায়
কেঁপে কেঁপে ওঠে যেন।
বিচিত্র! অপূর্ব!
চারিদিকে ঘুমের ছোঁয়ায় সব বুঝি নিঝুম হয়ে গেছে। সেই অতল মৌনতার মাঝে গিটারে মধুর বাজনা স্বপ্নালোক থেকে
যেন ভেসে আসছে বলেই মনে হয়। এ বুঝি
কোন ব্যথিতের বুকছরা
কান্না নিশীথ রাতের মৌনতার বুকে
হাহাকার জাগিয়ে তুলছে।
রেলিংয়ের কোল ঘেষে যে চেয়ারখানা রয়েছে, কে যেন তার ওপর বসে আপন
মনে গিটার বাজাচ্ছে।
কিরীটী পায়ে পায়ে চেয়ারের ঠিক পিছনটিতে এগিয়ে এসে দেখে—এ কি, এ যে
ডাক্তার সান্যাল?
কিরীটী সবিস্ময়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। শুনতে লাগল বাজনা।
অনেকক্ষণ বাজিয়ে বাজিয়ে ডাক্তার একসময় বাজনাটা কোলের ওপর নামিয়ে
রাখলেন।
আর একটু পরে কিরীটী আস্তে আস্তে ডাকলে, ডাক্তার সান্যাল!
কে? বলে ডাক্তার ফিরে তাকালেন। ধূর্জটিবাবু!
ঘুমোননি?
না।
বলে কিরীটী একটু মৃদু
হাসল, তারপর বললে, আপনিও তো দেখছি ঘুমোননি!
না।
অন্ধকার আমার বড় ভাল লাগে। অন্ধকার রাতে একা একা চুপটি করে বসে থাকলে মনটা যেন কানায় কানায় ভরে
ওঠে। যেন নিজেকে খুঁজে পাই।
আপনার বাজনার হাত বড় চমৎকার। কতক্ষণ থেকে যে আপনার বাজনা শুনছি!
ডাক্তার কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন, কিছু,
বললেন না।
ডাক্তারের কেবিনটা একেবারে জাহাজের ঐ ধারে। একসময় ডাক্তার বিদায়
নিয়ে কেবিনের দিকে চলে গেলেন।
কিরীটী কিন্তু তার পরেও অনেকক্ষণ ডেকের ওপর ঘুরে ঘুরে
বেড়াল। রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের বুকে ঢেউগুলো
ভেঙে ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। ঢেউয়ের বুকে সাদা সাদা ফেনা ফসফরাসের আলোয় যেন শুভ্র
রজনীগন্ধার স্তবকের মতই মনে হয়। হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে কিরীটী দেখল রাত্রি তখন দেড়টা।
আর বেশীক্ষণ জাগলে শরীর খারাপ হবে ভেবে কিরীটী কেবিনের দিকে পা বাড়াল।
কেবিনের দরজার কাছাকাছি আসতেই একটা অস্পষ্ট শিস শোনা গেল। কিরীটী
থমকে দাঁড়াল।
আবার একটা শিস শোনা গেল। এবারের শিসটা আগের চাইতেও অনেক স্পষ্ট।
আবার একটা শিস!
পর পর তিনটে শিস শোনা গেল। কিরীটীর আর কেবিনে ঢোকা হল না। আন্দাজে ভর করে শিসের আওয়াজটা
যেদিক হতে আসছে, প্রথমে সেইদিকেই সে এগিয়ে গেল। তারপর আবার যেন কি ভেবে ফিরে গিয়ে
কেবিনে প্রবেশ করে সুটকেস থেকে টর্চটা নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।
দোতলার ডেকের সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে কতকগুলো
প্যাকিং-করা কাঠের বাক্স স্তুপাকারে সাজানো রয়েছে। তারই ওধার থেকে কাদের যেন
তর্কবিতর্কের চাপা স্বর শোনা গেল।
কিরীটী বিস্ময় ও কৌতুহলে
প্যাকিং-করা বাক্সগুলোর আড়ালে এগোতে এগোতে কথাগুলো শুনতে পেল–
এখনও বল, সেই নোট-বইটা কি করেছিস? বক্তার কণ্ঠে কঠিন আদেশের সুর।
জানি না—আমি জানি না। কার যেন কাতরোক্তি শোনা গেল।
হ্যাঁ জানিস। আমার কালো ঢোলা জামাটার পকেটে ছিল। সেদিন রাতে সু ফ্যাক্টরীর মধ্যে জামাটা
একটা লোহার গায়ে ঝুলিয়ে রেখে ঘুমিয়েছিলাম, সে কথা তো তুই ছাড়া আর কেউ জানত না।…ভোরবেলা
উঠে পকেটে আর নোটবইটা পাইনি। পরের দিন নানা গোলমালে ছিলাম, সেজন্য ওদিকে নজর দিতে
পারিনি। তুই ভেবেছিলি খুব আমার চোখে ধুলো দিলি, না?
অন্য পক্ষ বোধ হয় চুপ করে রইল, কোনো জবাব শোনা গেল না।
গর্দভ! তুই আমার চোখে ধুলো দিবি? সেই লোকটা যেন কাউকে আদেশ দিল—এই, বুকে হুল ফোটা!
পরমুহতেই একটা অস্পষ্ট যন্ত্রণাকাতর শব্দ নিশীথের অন্ধকারে জেগে
উঠল।
উঃ, লোকটা কি পিশাচ!
উঃ! থাম, থাম, ফোটাসনি, বলছি বলছি।
বল।
লোকটা বোধ হয় গভীর যন্ত্রণায় হাঁপাতে থাকে।
***
কিরীটী বাক্সগুলোর গায়ে গায়ে পা দিয়ে উঠতে লাগল। ওপাশের একটা আলোর
খানিকটা রশ্মি তির্যকভাবে এদিকে এসে পড়েছে। সেই মৃদু আলোয় কিরীটী দেখলে—সেখানে তিনজন লোক।
একজনের হাত-পা বেধে একপাশে ফেলে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর দুজন এক
পাশে দাঁড়িয়ে।
হাত-পা-বাঁধা লোকটা বললে, আমার কাছে নোট-বইটা আছে বটে, কিন্তু তার
ভিতরে যে একটা ছক আঁকা কাগজ ছিল, সেটা নেই।
কি করেছিস সে কাগজটা?
লোকটা তখন ভয়ে ভয়ে—সেদিন কেমন করে তার হাত থেকে ১৮নং বাড়িতে সেই
সাংকেতিক কাগজটা চুরি হয়ে গিয়েছিল, সে-সব কথা একে একে খুলে বললে।
কেন তুই আমার নোট-বুক
চুরি করেছিলি?
তুমি কে—আজ ছ বছর তোমার পাশে আছি, তোমার সমস্ত আদেশ নীরবে বিনা
বিচরে সবদা মাথা পেতে নিয়েছি, পালন করছি, তোমারই আদেশে কতদিন নিশ্চিত মৃত্যুর
মধ্যে বিনা দ্বিধায় ঝাঁপ দিয়ে পড়েছি, কিন্তু যার জন্য দিবারাত্র এমনি করে
জীবন-মত্যু নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলেছি সে যে কে— আজ পর্যন্ত হাজার চেষ্টাতেও তা
জানতে পারিনি। তোমার ধন-সম্পত্তির ওপরে আমার এতটুকুও লোভ নেই, কেননা তুমি তো না
চাইতেই যথেষ্ট দাও। আমি জানতে চাই—তুমি কে তুমি কে? লোকটা
বলতে বলতে গভীর উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল।
যে দুজন দাঁড়িয়েছিল, তাদের একজন চাপা গলায় খিল খিল করে হেসে উঠল,
তারপর সহসা গম্ভীর হয়ে বললে, আমি কে?
অ্যাঁ! আমি কে?…
তোর দুরাকাঙক্ষাই
শেষ পর্যন্ত তোর মত্যুর কারণ হল। সেই সাংকেতিক ছক আঁকা কাগজটা কে নিয়েছে তাও আমি
জানি, সেটা আমি উদ্ধার করবই।
হতভাগা কিরীটী রায় আজও বুঝতে পারেনি যে, হিংস্র কেউটে সাপ নিয়ে সে
খেলতে শুরু করেছে!…তোর আগেও দলের আর দুজন আমায় জানবার চেষ্টা করেছিল, শেষ
পর্যন্ত তাদের সে ইচ্ছা বুকে নিয়েই মত্যুকে বরণ করতে হয়েছে।
তারপর সহসা সে পাশে দাঁড়ানো লোকটার দিকে ফিরে কঠিন নির্মম আদেশের সুরে বললে, ফেলে দে
হতভাগাটাকে এখনই স্ম্রদ্রের
জলে! জলের অন্ধকারে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যখন ও তিল তিল করে মত্যুর মুখে এগিয়ে যাবে,
হতভাগা তখন জানতে পারবে, কে আমি! কি আমার পরিচয়!
না না, আমায় এমনি করে জলের মধ্যে ড়ুবিয়ে মেরো না। এবারের মত আমায়
ক্ষমা কর, প্রতিজ্ঞা করছি, এ জীবনে আর তোমার পরিচয় জানবার চেষ্টা করব না।
আবার সেই নিষ্ঠুর হাসি।
হিংস্র হাঙরে যখন তোর দেহ ধারালো দাঁতে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে
খাবে, তখন জানবি আমি কে!
ক্ষমা কর আমায়! ক্ষমা কর!
ফেলে দে! দে!
পাশে দণ্ডায়মান লোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে নীচু হয়ে লোকটাকে অবলীলাক্ৰমে তুলে উঁচু করে তখনই রেলিং টপকে
নীচের গজমান অতল পারাপারহীন সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করল।
একটা বুক-ভাঙা আকুল চিৎকার নিশীথ রাত্রির গভীর স্তব্ধতাকে মহতের
জন্য যেন আলোড়িত করে তোলে। ঝপাং করে একটা শব্দ শোনা যায় মাত্র।
সমগ্র ব্যাপারটা এত চকিত ও এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেল যে,
কিরীটী বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। একটা টু শব্দ পর্যন্ত তার মুখে ফুটে বের হল না। স্থাণুর মতই কিরীটী প্যাকিং
বাক্সটার ওপরে দাঁড়িয়ে রইল। পা দুটো যেন পাথরের মত ভারী ও অনড় হয়ে গেছে।
কেউ জানলে না, কেউ শুনলে না, রাত্রির নিস্তব্ধ অন্ধকারে একজনের
জীবন্ত সলিল সমাধি হয়ে গেল। সাগরের কালো জলের তলে চিরনিদ্রায় সে অভিভূত
হল। কিরীটীর যেন দম আটকে আসে।…
হতভাগা ভেবেছিল, আমার চোখে ধূলো দেবে। কিন্তু কি করব, এ ছাড়া উপায়
ছিল না। বলতে বলতে লোকটার কণ্ঠস্বর কেমন যেন জড়িয়ে আসে। তারপর যেন কতকটা জোর করেই
আপনাকে সামলে নিয়ে দ্বিতীয় লোকটির দিকে ফিরে বললে, ওই লোকটাকে বরাবর মৃত্যুগুহায়
নিয়ে যাবে। জাহাজে আর তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। বলেই লোকটা ফিরে দাঁড়াল।
ফিরে দাঁড়াতেই সামনের একটা আলোর খানিকটা বাঁকা হয়ে এসে তার মুখের
উপর পড়ল।
কিরীটী বিস্ময়ে আতঙ্কে চমকে উঠল। অন্ধকারে চলতে চলতে সামনে
বিকটাকার ভূত দেখলেও বুঝি মানুষ এতটা চমকে ওঠে না।