Chapter Index

    সাঙ্কেতিক লেখা

    লোকটা
    এত গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাগজখানি দেখছিল যে অতর্কিত ভাবে পশ্চাৎ দিক থেকে সহসা
    আক্রান্ত হওয়ায় প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে অতি অল্পক্ষণের জন্যই, পরক্ষণে
    সে শরীরের সমস্ত বলটুকু প্রয়োগ করে আক্রমণকারীর কবল থেকে আপনাকে মুক্ত করার জন্য
    সচেষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু আক্রমণকারীর সুকঠিন
    আলিঙ্গন তখন লৌহদানবের মতই লোকটাকে নিষ্পেষিত করছে।

    সেই স্বল্প আলো-আঁধারে ঘরের ধূলিমলিন মেঝের ওপরেই আরম্ভ হল দুজনের
    তখন প্রবল হুটোপুটি।
    শক্তির দিক দিয়ে উভয়ের কেউ কম যায় না। ধস্তাধস্তিতে পায়ের ধাক্কায় মোমবাতিটা
    উল্টে নিভে গেল ও সঙ্গে সঙ্গে নিচ্ছিদ্র আঁধারে সমস্ত ঘরখানি জমাট বেধে উঠল।
    শীঘ্রই জগন্নাথের আসুরিক শক্তির কাছে লোকটাকে পরাভব স্বীকার করতে হল ও ক্রমে ক্রমে
    সে নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল। জোরে জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ হতে লাগল। ধীরে অতি ধীরে লোকটা
    একসময় শেষ পর্যন্ত জগন্নাথের শক্তির কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত হল।

    ক্লান্ত অবসন্ন পরাভূত লোকটাকে মাটির ওপর ফেলে বুকের ওপরে চেপে
    বসে জগন্নাথ পকেট থেকে একটা সিল্ক
    কর্ড বের করে ক্ষিপ্রহস্তে লোকটার হাত-পা বেধে ফেলল।

    গভীর শ্রান্তিতে জগন্নাথের সমগ্র শরীর তখন অবসন্ন ও ক্লান্ত। ঘামে
    জামাকাপড় সব ভিজে উঠেছে। সে হাত দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিল। পকেট থেকে অতঃপর
    টর্চটা বের করে টিপতেই উজ্জল একটা আলোর ইশারায় ঘরের জমাট আঁধারের খানিকটা যেন জট
    পাকিয়ে সরে গেল।

    এতক্ষণে টর্চের আলোয় লোকটাকে বেশ ভাল করে দেখা গেল। দোহারা।
    বলিষ্ঠ চেহারা। গায়ে একটা পাটকিলে-রংয়ের মের্জাই।
    মাথার চুলগুলো ছোট ছোট
    করে ছাঁটা। মুখটা গোল। নাকটা চ্যাপটা। চোখ দুটো ছোট ছোট। লোকটা পিট পিট করে
    জগন্নাথের দিকে তাকাচ্ছিল।

    অদূরে একটা কাগজ পড়ে আছে। জগন্নাথ ঝুকে হাত বাড়িয়ে কাগজটাকে তুলে নিল, তারপর
    টর্চের আলোয় কাগজটাকে মেলে ধরল।

    কাগজটা সাধারণ কাগজ নয়। নীল রংয়ের একটা অয়েল-পেপার। কাগজটার গায়ে
    একটা মানচিত্র আঁকা এবং তার নীচে কতকগুলো সাঙ্কেতিক চিহ্ন পর পর সাজানো রয়েছে। কাগজটার এক কোণে একটা
    ড্রাগনের মুর্তি–মুর্তিটি
    রক্তের মত টকটকে লাল কালিতে আঁকা।

    ড্রাগনের মূর্তির নীচে ছোট ছোট অক্ষরে লাল কালি দিয়ে ইংরাজী-বাংলা
    মিশিয়ে কি একটা লেখা আছে। লেখাটা অনেকটা কবিতার মত করে সাজানো। যদিও কবিতাটার
    মাথামুণ্ডতে যেমন কোন কিছু মিল নেই, তেমনি সমস্তটা একেবারে দুর্বোধ্য।

    মিয়াং–ভাঙা
    বুদ্ধদেবের মুর্তি।
    প্যাগোডার দক্ষিণে তার ডানদিকে চন্দন গাছ—মুর্তির
    গায়ে গোল চিহ্ন—ভ্রমর আঁকা।

    —সেই গাছের
    ৯০ সোপা পিঠের পরে
    দুই DK ০ ০ ০ হাত
    পারা সস্তা আছে
    চিহ্ন যত বাদ গেছে
    তার BAMT ধরে
    হাত ০ ০ ০ ০ যাও যদি মাত।
    ড্রাগন দেখ বসে আছে
    ধনাগারের চাবি কাছে
    মুখে তার লোহার বালা
    দুলছে তাতে চিকন শলা;
    দুইয়ের পিঠে শুন্য নাও
    ত্রিশ দিয়ে গুণ দাও,
    শূন্য যদি যায় বাদ
    সেই কবারে পূরবে সাধ ॥

    জগন্নাথ বার দুই-তিন কাগজটা আগাগোড়া পড়ে ফেলল। কিন্তু মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না।

    অথচ এটা বুঝতে তার কষ্ট হয় না যে জিনিসটা একটা সাঙ্কেতিক লিপি,
    একটা-না-একটা কিছু এর
    অর্থ আছেই।

    আরও ভাল করে চিন্তা
    করলে হয়তো তখন অর্থ ধরা যেতে পারে।

    কিন্তু এইভাবে এখানে আর দেরী করাও সমীচীন হবে না।

    একটু আগে যে অস্ফুট কাতরোক্তি শোনা গিয়েছিল, সে ব্যাপারটার একটা
    খোঁজ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এবং ক্ষণপূর্বে
    অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে যে কথাবার্তা ও শুনেছিল তা থেকে স্পষ্টই মনে হয়, এখান এই পোড়ো বাড়ির
    কোন কক্ষে নিশ্চয়ই কাউকে এরা ধরে নিয়ে এসে বন্দী করে রেখেছে।

    জগন্নাথ ভূপতিত রজ্জুবদ্ধ
    লোকটার দিকে একবার তাকাল।

    লোকটা যেন একেবারে নির্বিকার, যেন ভালমন্দ কিছুই জানে না, নেহাৎ
    একেবারে গোবেচারী গোছের।

    জগন্নাথ তাড়াতাড়ি কাগজটা ভাঁজ করে জামার ভিতর দিককার পকেটে রেখে
    লোকটার সামনে এগিয়ে এল।

    লোকটার মুখের ওপরে টর্চের আলো ফেলে কঠিন আদেশের স্বরে ভাঙা ভাঙা
    হিন্দুস্থানীতে প্রশ্ন করলে, এই, যে লোকটাকে তোরা এখানে ধরে এনে আটক করে রেখেছিস,
    সে কোন ঘরে শীঘ্র বল, না হলে গলা টিপেই তোকে এখানে শেষ করে রেখে যাব।

    লোকটা যে জগন্নাথের কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারেনি তা স্পষ্টই বোঝা
    গেল; সে ওর কথার কোন জবাবই দিল না, কেবল নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থেকে শুধু জগন্নাথের মুখের দিকে
    ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতই তাকাতে লাগল।

    এবারে লোকটাকে পা দিয়ে একটা ঠেলা দিয়ে জগন্নাথ বললে, এই, চুপ করে আছিস কেন? জবাব দে না বেটা!

    ঐ সময় আবার সহসা পূর্বের
    সেই গোঙানির শব্দটা শোনা গেল। জগন্নাথ এবারে
    অত্যন্ত
    অসহিষ্ণু
    হয়ে বললে, এই, বল!

    লোকটি তথাপি নীরব। সে আগের মতই বোকা-চাউনি নিয়ে চেয়ে আছে।

    না, এর কাছ হতে জবাব পাওয়া যাবে না দেখছি। জগন্নাথ মনে মনে বললে।
    তারপর সে একটা রুমাল
    বের করে লোকটার মুখ চেপে বেধে দিল, যাতে করে লোকটা চিৎকার বা কোন শব্দ করলেও কেউ
    শুনতে না পায়।

    থাক বেটা, যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর। বলতে বলতে জগন্নাথ ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে
    বাইরে থেকে ঘরের শিকলটা তুলে দিল।

    অন্ধকার বেশ জমাট হয়ে উঠেছে। দেওয়ালের কোন ফাটলে বুঝি একটা ঝিঁঝি পোকা
    ঝিঁঝি করে একটানা বিশ্রী শব্দে ডেকে চলেছে তো চলেছেই।

    টীকা