কবি
    বীণা হাতে আমি তব সিংহাসনতলে
    কালে কালে আসি কবি–কভু পরি গলে
    জয়মালা, কভু হিংস্র নির্দয় বিদ্রূপ
    তুলে লই অকুণ্ঠিতে, খুঁজে ফিরি রূপ
    সৃজনের ছায়াধূপে, আকাশে আলোকে,
    ধরণী, ড়ুকারি ওঠে যে ব্যর্থতা-শোকে,
    তারও মাঝে স্বপ্ন খুঁজি, বীণাতারে বুনি
    তারও সুর,–আনুমনে গান গাই গুণী!
    তুলিয়া লয়েছি আমি পতাকা তোমার,
    হে সুন্দর, আমি তব দৌবারিক–দক্ষিণের দ্বার
    উন্মুক্ত রেখেছি নব নবীনের লাগি!
    অন্ধকারে দীপ হাতে আছি আমি জাগি।
    আমি হেরিয়াছি–শুভ্ৰ তোমার গৌরব
    ঘৃণ্য নগণ্যের মুখে, কালে কালে করিয়াছে স্তব
    বীভৎস কুৎসিত কুণ্ডে, পঙ্কের ভাণ্ডারে
    তোমারেই; দেখিয়াছি তুমি আসি দাঁড়ায়েছ দ্বারে
    অন্ধকারে—রিক্ত তারে করিয়াছ জয়ী
    তোমার মঞ্জীর-স্পর্শে চুপে রহি রহি!
    বিকৃত তৃষ্ণার ব্যথা—বন্ধনের রক্তকৃষ্ণ রেখা
    বিনাশিয়া আরুণিমা দিয়ে গেছ দেখা
    রাত্রির যাত্রীর ভীত নিঃস্পনিদত চোখে!—
    অতি দূর অনাগত স্বপ্নের আলোকে
    আগতের ভাবলোকে তুলেছ উৎসব।
    কবি আমি, যুগে যুগে করি তব স্তব!
    দিবস-নিশার রক্ত—দহনের আলো
    জাগায় বিনিদ্র ব্যথা–তবু বাসি ভালো
    সুর তার; যা হারাল, পাব নাকো ফিরে,
    তারই খোঁজে নিত্য ঊষা গোধূলির তীরে
    ফিরি আমি–অশ্রুমান, ব্যথার তাপস!
    ভালোবাসি বেদনারে, ঐশ্বর্যের যশ
    চাহিনাকে–মাগি নাকো প্ৰসাদ সম্মান
    আমি কবি–পথে পথে গেয়ে যাব গান;
    পদে পদে মৃত্তিকারে মঞ্জীরের মতো
    বাজায়ে চলিব আমি—আমি অনাহত
    আদি মানবের ছন্দে উঠিব ঝঙ্কারি
    নীলিমার জয়গান–শ্যামশম্প নিঙাড়ি নিঙাড়ি
    ভরি লব শোণিতের সুরাপাত্রখানা!
    যে-ছবি ফোটে নি। আজও–যেই রূপ অনামা, অজানা
    সিন্ধুতীরে পেতে লব রৌদ্রের শয়ন;
    তাম্রঅঙ্গে শঙ্খচূর্ণ ধূম্রবালু মাখি,
    কলরবে পায়ে-চলা পথ যাব আঁকি
    সমুদ্রফেনার মতো; যেই কথা কহে নাই কেউ
    যে গান গায়নি কেহ—তারি সিন্ধু ঢেউ
    তুলে যাব কূলে কূলে–পৃথিবীর প্রথম বয়স
    ফিরায়ে আনিব আমি—আদি ঊষা—আদিম দিবস,
    উর্মিস্নাত মানবের অসীম উল্লাস,
    প্রথম রহস্য-ব্যথা–বিস্ময়ের ত্রাস,
    প্রকাশ করিব মোর স্নায়ুর যৌবনে!
    আদিম সন্তান আমি—রোম-শিহরণে
    গাব গান; স্বর্ণশীর্ষ নীবারমঞ্জরী—
    মধ্যাহ্ন রৌদ্রের বুকে আপনারে ছিন্ন করি করি।

    টীকা