গন্ধর্ব সৌরসেন সুরলোকের সংগীতসভায়                   কলানায়কদের অগ্রণী।সেদিন তার প্রেয়সী মধুশ্রী গেছে সুমেরুশিখরে                       সূর্যপ্রদক্ষিণে।           সৌরসেনের মন ছিল উদাসী।অনবধানে তার মৃদঙ্গের তাল গেল কেটে,    উর্বশীর নাচে শমে পড়ল বাধা,        ইন্দ্রাণীর কপোল উঠল রাঙা হয়ে।স্খলিতছন্দ সুরসভার অভিশাপে        গন্ধর্বের দেহশ্রী বিকৃত হয়ে গেল,অরুণেশ্বর নাম নিয়ে তার জন্ম হল               গান্ধাররাজগৃহে।        মধুশ্রী ইন্দ্রাণীর পাদপীঠে মাথা রেখে পড়ে রইল;বললে, “বিচ্ছেদ ঘটিয়ো না,           একই লোকে আমাদের গতি হোক,               একই দুঃখভোগে, একই অবমাননায়।’শচী সকরুণ দৃষ্টিতে ইন্দ্রের পানে তাকালেন।    ইন্দ্র বললেন,”তথাস্তু, যাও মর্তে–        সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে।           সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন-অপরাধের ক্ষয়।’        মধুশ্রী জন্ম নিল মদ্ররাজকুলে, নাম নিল কমলিকা।         একদিন গান্ধারপতির চোখে পড়ল মদ্ররাজকন্যার ছবি।সেই ছবি তার দিনের চিন্তা, তার রাত্রের স্বপ্নের ‘পরে               আপন ভূমিকা রচনা করলে।        গান্ধারের দূত এল মদ্ররাজধানীতে।           বিবাহপ্রস্তাব শুনে রাজা বললে,               “আমার কন্যার দুর্লভ ভাগ্য।’        ফাল্গুন মাসের পুণ্যতিথিতে শুভলগ্ন।    রাজহস্তীর পৃষ্ঠে রত্নাসনে মদ্ররাজসভায়এসেছে মহারাজ অরুণেশ্বরের অঙ্কবিহারিণী বীণা।        স্তব্ধসংগীতে সেই রাজপ্রতিনিধির সঙ্গে কন্যার বিবাহ।               যথাকালে রাজবধূ এল পতিগৃহে। নির্বাণদীপ অন্ধকার ঘরেই প্রতি রাত্রে স্বামীর কাছে বধূসমাগম।    কমলিকা বলে, “প্রভু, তোমাকে দেখবার জন্যেআমার দিন আমার রাত্রি উৎসুক। আমাকে দেখা দাও।’        রাজা বলে, “আমার গানেই তুমি আমাকে দেখো।’           অন্ধকারে বীণা বাজে।        অন্ধকারে গান্ধর্বীকলার নৃত্যে বধূকে বর প্রদক্ষিণ করে।    সেই নৃত্যকলা নির্বাসনের সঙ্গিনী হয়ে এসেছে               তার মর্তদেহে।নৃত্যের বেদনা রানীর বক্ষে এসে দুলে দুলে ওঠে,        নিশীথরাত্রে সমুদ্রে জোয়ার এলে           তার ঢেউ যেমন লাগে তটভূমিতে–               অশ্রুতে প্লাবিত করে দেয়।                একদিন রাত্রির তৃতীয় প্রহরের শেষে                   যখন শুকতারা পূর্বগগনে,কমলিকা তার সুগন্ধি এলোচুলে রাজার দুই পা ঢেকে দিলে;        বললে, “আদেশ করো আজ উষার প্রথম আলোকে                   তোমাকে প্রথম দেখব।’রাজা বললে, “প্রিয়ে, না-দেখার নিবিড় মিলনকে                   নষ্ট কোরো না এই মিনতি।’        মহিষী বললে, “প্রিয়প্রসাদ থেকে               আমার দুই চক্ষু কি চিরদিন বঞ্চিত থাকবে।        অন্ধতার চেয়েও এ যে বড়ো অভিশাপ।’               অভিমানে মহিষী মুখ ফেরালে।    রাজা বললে, “কাল চৈত্রসংক্রান্তি।নাগকেশরের বনে নিভৃতে সখাদের সঙ্গে আমার নৃত্যের দিন।           প্রাসাদশিখর থেকে চেয়ে দেখো।’        মহিষীর দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল;               বললে, “চিনব কী করে।’    রাজা বললে, “যেমন খুশি কল্পনা করে নিয়ো,                       সেই কল্পনাই হবে সত্য।’            চৈত্রসংক্রান্তির রাত্রে আবার মিলন।মহিষী বললে, “দেখলাম নাচ। যেন মঞ্জরিত শালতরুশ্রেণীতে                                  বসন্তবাতাসের মত্ততা।               সকলেই সুন্দর,           যেন ওরা চন্দ্রলোকের শুক্লপক্ষের মানুষ।কেবল একজন কুশ্রী কেন রসভঙ্গ করলে, ও যেন রাহুর অনুচর।            ওখানে কী গুণে সে পেল প্রবেশের অধিকার।’                   রাজা স্তব্ধ হয়ে রইল।    কিছু পরে বললে, “ওই কুশ্রীর পরম বেদনাতেই তো সুন্দরের আহ্বান।কালো মেঘের লজ্জাকে সান্ত্বনা দিতেই সূর্যরশ্মি তার ললাটে পরায় ইন্দ্রধনু,    মরুনীরস কালো মর্তের অভিশাপের উপর স্বর্গের করুণা যখন রূপ ধরে               তখনই তো শ্যামলসুন্দরের আবির্ভাব।প্রিয়তমে, সেই করুণাই কি তোমার হৃদয়কে কাল মধুর করে নি।’    “না মহারাজ, না’ ব’লে মহিষী দুই হাতে মুখ ঢাকলে।               রাজার কণ্ঠের সুরে অশ্রুর ছোঁওয়া লাগল;           বললে, “যাকে দয়া করলে হৃদয় তোমার ভরে উঠত               তাকে ঘৃণা ক’রে মনকে কেন পাথর করলে।’    “রসবিকৃতির পীড়া সইতে পারি নে’           এই ব’লে মহিষী আসন থেকে উঠে পড়ল।               রাজা তার হাত ধরলে;বললে, “একদিন সইতে পারবে আপনারই আন্তরিক রসের দাক্ষিণ্যে–               কুশ্রীর আত্মত্যাগে সুন্দরের সার্থকতা।’           ভ্রূ কুটিল করে মহিষী বললে,“অসুন্দরের জন্যে তোমার এই অনুকম্পার অর্থ বুঝি নে।           ওই শোনো, উষার প্রথম কোকিলের ডাক,               অন্ধকারের মধ্যে তার আলোকের অনুভূতি।আজ সূর্যোদয়মুহূর্তে তোমারও প্রকাশ হবে               আমার দিনের মধ্যে, এই আশায় রইলাম।’        রাজা বলল, “তাই হোক, ভীরুতা যাক কেটে।’               দেখা হল।        ট’লে উঠল যুগলের সংসার।           “কী অন্যায়– কি নিষ্ঠুর বঞ্চনা’বলতে বলতে কমলিকা ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে গেল।                    গেল বহুদূরেবনের মধ্যে মৃগয়ার জন্যে যে নির্জন রাজগৃহ আছে সেইখানে।               কুয়াশায় শুকতারার মতো লজ্জায় সে আচ্ছন্ন।রাত্রি যখন দুই প্রহর তখন আধ-ঘুমে সে শুনতে পায়               এক বীণাধ্বনির আর্তরাগিণী।                   স্বপ্নে বহুদূরের আভাস আসে,                       মনে হয় এই সুর চিরদিনের চেনা।                   রাতের পরে রাত গেল।অন্ধকারে তরুতলে যে মানুষ ছায়ার মতো নাচে                   তাকে চোখে দেখে না, তাকে হৃদয়ে দেখা যায়–যেমন দেখা যায় জনশূন্য দেওদার বনের দোলায়িত শাখায়                       দক্ষিণসমুদ্রের হাওয়ার হাহাকার-মূর্তি।                এ কী হল রাজমহিষীর।           কোন্‌ হতাশের বিরহ তার বিরহকে জাগিয়ে তোলে!    মাটির প্রদীপ-শিখায় সোনার প্রদীপ জ্বলে উঠল বুঝি।        রাতজাগা পাখি নিস্তব্ধ নীড়ের পাশ দিয়ে হূহু করে উড়ে যায়,তার পাখার শব্দে ঘুমন্ত পাখির পাখা উৎসুক হয়ে ওঠে যে।            বীণায় বাজতে থাকে কেদারা, বেহাগ, বাজে কালাংড়া।আকাশে আকাশে তারাগুলি যেন তামসী তপস্বিনীর নীরব জপমন্ত্র।           রাজমহিষী বিছানার ‘পরে উঠে বসে।               স্রস্ত তার বেণী, ত্রস্ত তার বক্ষ।বীণার গুঞ্জরণ আকাশে মেলে দেয় এক অন্তহীন অভিসারের পথ।           রাগিণী-বিছানো সেই শূন্যপথে বেরিয়ে পড়ে তার মন।        কার দিকে। দেখার আগে যাকে চিনেছিল তারই দিকে। একদিন নিমফুলের গন্ধ অন্ধকার ঘরে অনির্বচনীয়ের আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছে।    মহিষী বিছানা ছেড়ে বাতায়নের কাছে এসে দাঁড়ালো।        নীচে সেই ছায়ামূর্তির নৃত্য, বিরহের সেই উর্মি-দোলা।           মহিষীর সমস্ত দেহ কম্পিত।        ঝিল্লিঝংকৃত রাত, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ দিগন্তে।    অস্পষ্ট আলোয় অরণ্য স্বপ্নে কথা কইছে।সেই বোবা বনের ভাষাহীন বাণী লাগল রাজমহিষীর অঙ্গে অঙ্গে।        কখন নাচ আরম্ভ হল সে জানে না।           এ নাচ কোন্‌ জন্মান্তরের, কোন্‌ লোকান্তরের।               গেল আরো দুই রাত।অভিসারের পথ একান্তই শেষ হয়ে আসছে এই জানলারই কাছে।           সেদিন বীণায় পরজের বিহ্বল মিড়।    কমলিকা আপন মনে নীরবে বলছে,           “ওগো কাতর, ওগো হতাশ, আর ডেকো না।               আমার আর দেরি নেই।’           কিন্তু যাবে কার কাছে।        চোখে না দেখেছিল যাকে তারই কাছে তো?               কেমন করে হবে।দেখা-মানুষ আজ না-দেখা মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে        পাঠিয়ে দিলে সাত-সমুদ্র-পারে রূপকথার দেশে।               সেখানকার পথ কোন্‌ দিকে।                   আরো এক রাত যায়।           কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ডুবেছে অমাবস্যার তলায়।                   আঁধারের ডাক কী গভীর।    পথ-না-জানা যত-সব গুহা-গহ্বর মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন,        এই ডাক সেখানে গিয়ে প্রতিধ্বনি জাগায়।সেই অস্ফুট আকাশবাণীর সঙ্গে মিলে ওই যে বাজে বীণায় কানাড়া।        রাজমহিষী উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “আজ আমি যাব।           আমার চোখকে আমি আর ভয় করি নে।’পথের শুকনো পাতা পায়ে পায়ে বাজিয়ে দিয়ে               সে গেল পুরাতন অশথ গাছের তলায়।           বীণা থামল।        মহিষী থমকে দাঁড়ালো।    রাজা বললে, “ভয় কোরো না প্রিয়ে, ভয় কোরো না।’তার গলার স্বর জলে-ভরা মেঘের দূর গুরু-গুরু ধ্বনির মতো।    “আমার কিছু ভয় নেই, তোমারই জয় হল।’        এই বলে মহিষী আঁচলের আড়াল থেকে প্রদীপ বের করলে,           ধীরে ধীরে তুললে রাজার মুখের কাছে।    কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরোতে চায় না, পলক পড়ে না চোখে।           বলে উঠল, “প্রভু আমার, প্রিয় আমার,                   এ কী সুন্দর রূপ তোমার।’

    টীকা